logo

দূরত্ব ঘুচিয়ে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক কি ফের ঘুরে দাঁড়াবে?

অনলাইন রিপোর্ট

2025-08-10T05:05:06.291Z

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে। যে দুটি দেশ দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করত, তাদের মধ্যে এখন অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, যা শত্রুতা না হলেও বিদ্বেষের দিকে এগোচ্ছে।

ভারত যে বাংলাদেশকে একসময় তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র বলত, সেই দেশে এখন ভারতের ভিসা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। বাংলাদেশকে দেওয়া বিভিন্ন বাণিজ্য সুবিধা একের পর এক বাতিল করা হচ্ছে এবং অবকাঠামো ও জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ভারতের বহু প্রকল্পের কাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত আছে।

এমনকি দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফ-এর মধ্যে প্রায়শই সংঘাত ও সংঘর্ষ ঘটছে, যেখানে কখনো কখনো স্থানীয় গ্রামবাসীরাও জড়িয়ে পড়ছেন। দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানও প্রায় স্তব্ধ হয়ে আছে। পর্যটন বা চিকিৎসার জন্য ভারত সফর এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

>> আরও পড়তে পারেন

ভারত স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তারা ন্যূনতম প্রয়োজনের বাইরে কোনো বড় ধরনের ‘এনগেজমেন্ট’-এ আগ্রহী নয়। এর ফলে গঙ্গা চুক্তির নবায়ন এবং অভিন্ন নদীগুলোর জল বণ্টনের মতো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও থমকে আছে। দুই দেশের পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা একমত যে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত এক বছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে কোনোভাবেই বন্ধুত্বপূর্ণ বা স্বাভাবিক বলা যায় না।

যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এক বছর আগেও ‘সোনালি অধ্যায়’ বলা হতো, তা কেন এত দ্রুত ভেঙে পড়ল, তার পেছনে দিল্লিতে বিভিন্ন ব্যাখ্যা শোনা যায়। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটি হলো, ভারতের এই তথাকথিত সুসম্পর্কটি ছিল একজন ব্যক্তি বা একটি দলের সঙ্গে, পুরো দেশের সঙ্গে নয়।

ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ভারত শুধু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক দেখত। তার মতে, শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগগুলো মোকাবিলা করেছিলেন এবং বাণিজ্য ও সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত যা চেয়েছিল, তা তিনি করে দেখিয়েছিলেন, যা এর আগে কোনো সরকার করেনি।

কিন্তু এই সুবিধা পেতে গিয়ে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড নিয়ে জনরোষের দিকে নজর দেয়নি। শ্রীরাধা দত্তের মতে, ভারত শুধু দেখছিল তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো আছে, বাকিটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু ৫ আগস্টের পটপরিবর্তন এই পুরো চিত্রটি বদলে দেয়।

>> আরও পড়তে পারেন

তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় ও আতিথেয়তা পাওয়ার পর ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। এই ক্ষোভেরই প্রতিফলন বর্তমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে দেখা যাচ্ছে।

যে বাংলাদেশে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্বার্থ এবং বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে, সেখানেও কেন দিল্লি মসৃণ সম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যর্থ হলো?

দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আরআস-এর অধ্যাপক ড. প্রবীর দে মনে করেন, ভারত এই সম্পর্ককে খরচের খাতায় ফেলে দেয়নি, বরং গোটা বিষয়টাকে একটি ‘পজ’ বা সাময়িক বিরতির মোডে রেখেছে। তিনি বলেন, সম্পর্কটা বিগড়ে যায়নি। সম্পর্ক আছে... কিন্তু ব্যাপারটা এরকম যে দুটো বন্ধুর মধ্যে এখন কিছুদিন কথাবার্তা হচ্ছে না।

ড. প্রবীর দের মতে, ভারত এখন অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের ‘ফার্স্ট মুভ’-এর জন্য। এই ফার্স্ট মুভ সম্ভবত বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পরই হবে। তিনি আরও বলেন, দুই দেশই প্রতিবেশী, তাই তারা একে অপরের সঙ্গে থাকতে চায়, কিন্তু এবার যে আঘাত লেগেছে, তা আগে কখনো হয়নি।

ড. দে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যেভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে, তা ভারতের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম 'রেড লাইন'। এই সীমা অতিক্রম করায় দিল্লির পক্ষে ঢাকার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখা কঠিন।

দিল্লির কিছু বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে যদি উভয় দেশ একে অপরের বিশেষ প্রয়োজনের প্রতি গুরুত্ব দেয়। ভারতের বেশি দরকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, আর বাংলাদেশের দরকার জল। উভয় দেশ যদি এই অগ্রাধিকারগুলো উপলব্ধি করে, তাহলে সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব।

অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে ভারত-বিরোধী মনোভাব প্রবল, যা স্বাভাবিক করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। তার মতে, বাংলাদেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু হলো নদীর জলের ন্যায্য হিস্যা। এই বিষয়ে ভারত যদি পদক্ষেপ নেয়, তাহলে সম্পর্কে ম্যাজিক ঘটানো সম্ভব।

তিনি বলেন, ভারত যখন তিস্তার জল ব্যবস্থাপনার বিষয়ে চীনের প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল, তখন নিজেদের কোনো বিকল্প প্রস্তাব দেয়নি।

আরেকটি মতবাদ হলো, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও বাণিজ্যিক বাস্তবতা দুই প্রতিবেশীকে আবার কাছাকাছি আনতে পারে। আগামী বছর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত (LDC) দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হবে। এই উত্তরণের ফলে বাংলাদেশ কিছু বাণিজ্য সুবিধা হারাবে এবং নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দরকার ভারতকে।

অর্থনীতিবিদ ড. প্রবীর দে বলেন, পরের বছর, মানে ২০২৬-এ বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে উন্নীত হওয়ার পর যদি ফ্লাই করতে হয়... তাহলে বাংলাদেশের দরকার ইন্ডিয়াকে, ভারতবর্ষকে।

>> আরও পড়তে পারেন

তিনি উদাহরণ হিসেবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ৬৫ শতাংশ কার্গো ভারতের দরকার হবে। একইভাবে, অন্যান্য অর্থনৈতিক ও সংযোগ প্রকল্পের জন্যও বাংলাদেশের ভারতকে প্রয়োজন।

ড. দে বিশ্বাস করেন, যদি বাংলাদেশ এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে, তাহলে সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হতে পারে।

শেষ পর্যন্ত, দুই দেশেরই একে অপরকে খুব বেশি করে দরকার। তাই বর্তমানে যে শৈত্য বা ‘ফ্রিজ’ চলছে, তা সাময়িক এবং আগামী দিনে কেটে যেতে বাধ্য বলে অনেকে মনে করেন। সূত্র বিবিসি বাংলা

/এএস

logo
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: এম এইচ মামুন
অস্থায়ী কার্যালয়: সিদ্দিক ম্যানশন, পুরানাপল্টন, ঢাকা-১০০০।
ফোন : ০১৫৪০৫০৩৬৩৪
ই-মেইল: [email protected]
মুক্তকলাম © ২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত