logo
logo

ভারতের ভুল ‘বাংলাদেশ পলিসি’

অনলাইন রিপোর্ট

দক্ষিণ এশিয়া যে সমস্ত কারণে অশান্ত হয়ে আছে তার মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে ভারত। এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী দেশ ভারত। আয়তনে বিশাল হলেও এ দেশের নেতাদের মন খুব সংকীর্ণ। প্রতিবেশী দেশগুলো যাতে শান্তি ও স্বস্তিতে না থাকে এবং সমৃদ্ধ হতে না পারে সেটাই তাদের অহর্নিশ চিন্তা। দুনিয়ার তামাম শক্তিশালী দেশের সঙ্গে ইন্ডিয়া সমমর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক চায়। অথচ এই অঞ্চলের প্রতিটি ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশের ওপর সে চায় দাদাগিরি করতে, কর্তৃত্ব ফলাতে।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিশেষ করে চলচ্চিত্রে দেশটির বিরাট মনযোগ। আর সমরশক্তি বাড়াতে সদা সচেষ্ট তারা। দেশটিতে বুর্জোয়া, শিল্পপতি ও বড়ো ব্যবসায়ীদের ফুলে ফেঁপে ওঠার সুযোগ অবারিত। তবে অর্থনীতির সুষ্ঠু বিকাশ ও সুষম উন্নতি নেই। অঞ্চলে অঞ্চলে এবং মানুষে মানুষে বৈষম্য প্রবল। বর্ণাশ্রম প্রথায় দেশটি বিভক্ত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণে বিভক্ত হিন্দু সমাজ।

শূদ্রদের গালভরা হরিজন নাম দেওয়া হলেও তারা প্রকট বঞ্চনার শিকার। তাদের মানবাধিকার অস্বীকৃত। সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই হিন্দুদের শতকরা ৮০ ভাগই শূদ্র। এরা ছাড়াও ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হার শতকরা ২০ জনের বেশি; যাদের মধ্যে ১৫ শতাংশই মুসলমান। ইন্ডিয়া বৃটিশ শাসকদের অধিকারে যাওয়ার আগে সংখ্যালঘু এই মুসলমানেরাই হাজার বছর ধরে শাসন করেছে। এখন হিন্দুত্ববাদীদের হাতে শাসিত ভারতে মুসলমানেরা বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত ও নিগ্রহের শিকার।

দেশের ভেতরে সীমাহীন বৈষম্য ও বঞ্চনা জিইয়ে রেখে ভারতের শাসকেরা গোড়া থেকেই প্রতিবেশী অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর প্রতি অবলম্বন করে আসছে আধিপত্য ও সম্প্রসারণবাদী নীতি। ১৯৭৪ সালে বৃটিশ রাজশক্তির কবল থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত ছলে-বলে-কলে-কৌশলে দেশীয় রাজ্যগুলো অধিকার করে। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারির মধ্যেই রাজস্থান থেকে শুরু করে মণিপুর পর্যন্ত ২১৬টি দেশীয় রাজ্যকে তাদের সন্নিহিত প্রদেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। ২৭৫টি দেশীয় রাজ্য পাঁচটি রাজ্যে রূপান্তরিত হয় এবং ৬১টি দেশীয় রাজ্যকে ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। এরপর জুনাগড়, জম্মু-কাশ্মির এবং হায়দ্রাবাদ দখল করে নেয় ভারত। সর্বশেষে ১৯৭৫ সালে অধিকার করে সিকিম।

এর বাইরে কোনো একটা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই ভারতের। বরং দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা ইন্ডিয়ার বৈরী নীতির কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক প্রায়শই আধিপত্য বিস্তারমূলক, আর তাতেই আস্থাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আঞ্চলিক সহযোগিতার অন্যতম মঞ্চ সার্ক (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) কার্যকর হতে পারছে না, যার প্রধান কারণ ইন্ডিয়ার একচেটিয়া আধিপত্য ও দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলোকে সার্কের অগ্রগতিতে অন্তরায় হিসেবে ব্যবহার করা। ভারতের এই নীতি দক্ষিণ এশিয়ার একতা ও সহযোগিতার পথে বড় বাধা।

প্রতিবেশী দেশগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইন্ডিয়া নানাভাবে হস্তক্ষেপ করে আসছে। নানা রকম চাপ দিয়ে ও ফন্দি-ফিকির করে ভারত তার প্রতিবেশী প্রতিটি দুর্বল রাষ্ট্রের কাছ থেকে ষোলো আনা স্বার্থ আদায় করে নেয়। কিন্তু ওই সব প্রতিবেশী দেশের ন্যায্য প্রাপ্য মেটাতে ইন্ডিয়ার টালবাহানার কোনো সীমা থাকে না। কাজেই কোনো প্রতিবেশী দেশের দেশপ্রেমিক কোনো নাগরিক ভারতকে সুপ্রতিবেশী বলে মনে করতে পারে না। বরং সব সময় সন্দেহের চোখে দেখে এবং ভারতের মতলবের ব্যাপারে সচেতন থাকতে চায়। এই বাস্তবতার কারণে ভারত সবসময় প্রতিবেশী দেশগুলোতে তাদের পক্ষে তৎপরতা চালাতে এজেন্ট ও গুপ্তচর নিয়োগ করে থাকে। আর ভেতর ও বাইরে নানা রকম অপতৎপরতা চালিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায় ইন্ডিয়াপন্থী সরকার বসাতে চায়।

বাংলাদেশের কথা ধরলে এখানে ভারত তাদের অনুগত সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে বা টিকিয়ে রাখতে সবসময় তৎপর থেকেছে। এক্ষেত্রে তারা কোনো চক্ষুলজ্জা কিংবা কূটনৈতিক রীতিনীতি, সৌজন্যবোধ ও 'নাইসিটি'রও তোয়াক্কা করেনি। ভারতের কেন্দ্রে কোন পার্টি বা জোটের সরকার আছে তাতে এই আচরণের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ভারতে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় থাকতে তারা বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমকে প্রলম্বিত করতে প্রকাশ্যেই তৎপরতা চালিয়েছে। পাতানো নির্বাচনের বিরোধিতা কমিয়ে আনতে এবং একটা তথাকথিত গ্রহণযোগ্যতা দিতে সে সময় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এসে জাতীয় পার্টির নেতা এইচ এম এরশাদের ওপর প্রকাশ্যে চাপ দিয়েছিলেন ‘ভুয়া নির্বাচন বর্জন’ থেকে সরে আসতে। মোদির আমলে তো জাতীয় পার্টির গোলাম কাদেরকে নয়াদিল্লিতে ডেকে নিয়ে গিয়ে হাসিনার 'আমি-ডামি' নির্বাচনের শরিক হতে বাধ্য করা হয়েছিল।

এক-এগারো কাণ্ডের মূল হোতা জেনারেল মঈন ইউ আহমেদকে ছয় ঘোড়া ধরিয়ে দিয়ে তার মাধ্যমে হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর প্রধান কুশীলব যে ভারতই ছিল তা তো প্রণব মুখার্জী বই লিখেই জানান দিয়ে গেছেন। পিলখানায় সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসারদের পরিকল্পিত পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের প্রতিক্রিয়া সামলাতে না পারলে হাসিনাকে উদ্ধারে ইন্ডিয়ার সামরিক আয়োজন ও প্রস্তুতির ব্যাপার তো প্রায় সবাই জানে।

তালিকা দীর্ঘ না করেই বলে দেওয়া যায় যে, ক্ষমতাসীন হাসিনাকে দুর্বিনীত এক ফ্যাসিস্ট ঘাতকে পরিণত করার পেছনে ভারতের মদদই মূল ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণের প্রতি সব বৈরিতা ও অপতৎপরতা আড়াল করতে ভারত এদেশের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল-সংগঠনের বিরুদ্ধে সব সময় উগ্র ভারত-বিরোধিতার অভিযোগ প্রচার করেছে। ভারতের বিরুদ্ধে শত্রুতার নানা কল্পকাহিনী তারা রটনা করেছে।

গত প্রায় দেড় দশকে ভারত হাসিনাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকিয়ে রেখে তার আনুগত্যই বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থের একমাত্র ও পূর্ণ রক্ষাকবচ বলে বিবেচনা করেছে। অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কিংবা বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব ও অনুভূতিকে বিবেচনায় রাখারও কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি। দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গেই ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। কিন্তু এ সম্পর্ককে ভারত পুরোপুরি হাসিনানির্ভর করে রাখে। হাসিনার পতনের পর স্বাভাবিকভাবেই সে সম্পর্ক বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

হাসিনার পতন ভারতের কল্পনারও বাইরে ছিল। তাই তার পতন ভারতকে করে তুলেছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই অঞ্চলে ভারত তার স্বার্থের বিপন্ন দশা দেখে হতাশ ও অস্থির হয়ে উঠেছে। এই অস্থিরতা ভারতকে আরও বেশি ভুলের ফাঁদে আটকে ফেলছে। আচানক পতনের মুখে হাসিনা ভারতের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ওই সময়ে ভারত পুরো পরিস্থিতি ভালো করে পর্যালোচনারও অবকাশ পায়নি। হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে তারা ধরে নিয়েছিল এই আশ্রয় খুব সাময়িক ও সংক্ষিপ্ত হবে। হাসিনা অচিরেই ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের তৃতীয় কোনো দেশে চলে যাবেন; কিন্তু তা হয়নি। দুনিয়ার কোনো দেশই যে হাসিনাকে ঠাঁই দিতে অস্বীকার করবে তা' ভারতের ধারণাতেও ছিল না। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসিনাকে গলগ্রহ হিসেবে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেখে দিতে বাধ্য হয়েছে ভারত।

হাসিনার মতো একটি 'ক্যারেকটার'কে আশ্রয় দিলেও তাকে নিষ্ক্রিয় রাখা যায়নি। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে ওইখানে বসেই হাসিনা তার কূটচাল ও নানামুখী অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। তার দলবল ও সুবিধাভোগীদের সক্রিয় করতে সচেষ্ট হয়েছেন। প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে এই অপতৎপরতায় ভারত তার ভূখণ্ডকে ব্যবহারের সুযোগ হাসিনাকে দিচ্ছে। কেবল হাসিনাই নন, তার রেজিমের হত্যাযজ্ঞ ও লুণ্ঠনের হোতাদের আরও অনেকের জন্য ভারত হয়ে উঠেছে এক অভয়াশ্রম। এটা বাংলাদেশের প্রতি চরম অবৈরী আচরণ। শুধু তাই নয়, ভারতের উস্কানি ও মদদে বাংলাদেশে একটি সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টির প্রচেষ্টাও দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে। তারা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে যাতে ইউরোপ-আমেরিকাকে দিয়ে সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর একটা বড়ো রকমের চাপ প্রয়োগ করানো যায়।

এসব তৎপরতা চালাতে গিয়ে ভারত ভুলে যাচ্ছে যে আগেকার পরিস্থিতি আর নেই। দিন বদলে গেছে। ভারতের সমকক্ষ না হোক, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্ব আগের তুলনায় অনেক গুণে বেড়ে গেছে। সেটা চীনের কাছে যেমন, ঠিক তেমনই পশ্চিমা দুনিয়ার কাছেও। কাজেই এখন কেউই আর বাংলাদেশকে আগের মতো ভারতের চোখ দিয়ে দেখে না। এই অঞ্চলে বাংলাদেশ এখন ভারতের পরেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের সঙ্গে কেউই ভারতের মাধ্যমে নয়, সরাসরি সম্পর্ক রাখার নীতিতে বিশ্বাসী। কাজেই ভারতকে তাদের স্বার্থেই বাংলাদেশের ব্যাপারে ভুল নীতি ও হঠকারী কর্মপন্থা অবিলম্বে বদলাতে হবে। না হলে এ অঞ্চলে ইন্ডিয়ার জন্য হবে 'সকলি গরল ভেল!'

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেসসচিব।

ই-মেইল : [email protected]

undefined/news/country/199765


logo
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: এম এইচ মামুন
অস্থায়ী কার্যালয়: সিদ্দিক ম্যানশন, পুরানাপল্টন, ঢাকা-১০০০।
ফোন : ০১৫৪০৫০৩৬৩৪
ই-মেইল: [email protected]
মুক্তকলাম © ২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত